image_blog

সেকালের পৌষ -সঙ্ক্রান্তি

2023-01-06 11:52:11

একসময়ে পৌষ মাস ছিল বাঙালির পিঠে-উৎসবের মাস। শহর থেকে গ্রাম— এই উৎসব তখন চলত সবখানেই। তখনও যৌথ পরিবারে ভাঙন ধরেনি। মেয়েরা তখনও অন্দরমহল ছেড়ে চাকরির পথে পা বাড়াননি। একান্নবর্তী পরিবারে হেঁশেলের দায়িত্ব সামলাতেন মা-কাকিমা- জেঠিমারা। তাঁরাই রান্না শেখাতেন। সেই সময়ে পৌষসংক্রান্তির দিন বাঙালির হেঁশেল ম-ম করত পিঠেপুলি আর পায়েসের গন্ধে।কত ধরনের উপকরন দিয়ে তখন তৈরি হত নানা রকমের পিঠে। পুলিপিঠের মধ্যে থাকত মুগেরপুলি, ভাজাপুলি, দুধপুলি, চন্দ্রপুলি আর সেদ্ধপুলি। অন্য ধরনের পিঠে বলতে, পাটিসাপটা, গোকুলপিঠে, পোস্তর পিঠে, নারকেল পিঠে, সরুচাকলি, গড়গড়া, পাতসিজা ইত্যাদি।কী কী উপকরণ দিয়ে তৈরি হত এইসব পিঠে? আটা বা ময়দা, চালগুঁড়ো, দুধ, খোয়া ক্ষীর, নারকেল কোরা, চিনি, নলেনগুড়, মুগডাল বা বিউলির ডাল, পোস্ত আর সুজি। কখনও আলু বা মিস্টি আলুও ব্যবহার করা হত উপকরণ হিসেবে। আর থাকত পরিষ্কার সাদা কাপড়।

অনেক যত্ন ও সজাগ তত্ত্বাবধানে তৈরি হত এইসব পিঠে। পিঠে কতটা সুস্বাদু হবে, তা অনেকটা নির্ভর করে চাল কত নিখুঁত ভাবে গুঁড়ো করা হয়েছে, তার উপর।পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন গৃহস্থ বাড়িতে চাল ভিজিয়ে রাখা হত। পিঠে তৈরির জন্যে ভেজানো চাল কতটা নরম হতে হবে, এই বিষয়টা তখন মা-কাকিমাদের নখদর্পণে থাকত। তাঁদের নিঁখুত হিসেব একেবারে কাঁটায় কাঁটায় মিলেও যেত। এ তো গেল পিঠে তৈরির অাগের পর্ব। সংক্রান্তির দিন সকাল সকাল স্নান সেরে নিয়ে পরিষ্কার কাপড় পরতেন মা-কাকিমারা। তারপর শুরু হত পিঠে-পর্ব। পিঠে তৈরি করার সময় তাঁরা সতর্ক দৃষ্টিতে নজর রাখতেন নিজেদের হস্তশিল্পের উপর। হয়তো অজানা কোনও দেবতাকে বলতেন— মুখরক্ষা যেন হয়! তুমি দেখো, ঠাকুর!তখন ননস্টিক ফ্রাইং প্যান বা আধুনিক কোনও বাসনপত্রের জন্ম হয়নি। চালগুঁড়োও যে প্যাকেটবন্দি হতে পারে, সে ভাবনাও অকল্পনীয় ছিল। তা সত্ত্বেও কী নিঁখুত ভাবে তৈরি হত প্রত্যেকটা পাটিসাপটা আর অন্য পিঠেগুলো! উনুনে আগুনের আঁচ যেন গৃহিনীদের হাতের ছোঁয়ায় নিজে থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে যেত। একটা পাটিসাপটাও পুড়ে যেত না। তাওয়া আর খুন্তির যুগলবন্দিতে প্রত্যেকটাই কী দারুণ সুস্বাদু হয়ে উঠত!খুব সাবধানে তৈরি করা হত পুলিপিঠে। সেগুলো দুধে দিয়ে ফোটানোর সময় খুলে বা ফেটে গেলেই সর্বনাশ! সব পরিশ্রম তাহলে মাঠে মারা যাবে! কী উৎকণ্ঠাতেই না মা-কাকিমা-জেঠিমারা তাদের দিকে চেয়ে থাকতেন!

পিঠের সঙ্গে সংক্রান্তির দিনে তৈরি হত নতুনগুড় দিয়ে পায়েসও। নতুন চাল আর গুড়ে রসেই গন্ধ বাঙালির আরেক ঐতিহ্য! সংক্রান্তির সেই ঐতিহ্যপূর্ণ নৈবেদ্য বহু বাড়ি তে ই সর্বপ্রথমে গৃহদে বতাকে নিবেদন করা হত|